সর্বশেষ

10/সর্বশেষ/ticker-posts

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি বৈষম্য: মেধা ও অবদানকে অস্বীকার করার জাতীয় অপসংস্কৃতি

বাংলাদেশের প্রকৌশল খাত আজ একটি অদৃশ্য বর্ণবৈষম্যের মুখোমুখি। একদল স্বনামধন্য বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতকদের দাবির কাছে বলি হতে বসেছে হাজার হাজার ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের ভবিষ্যৎ। সম্প্রতি বুয়েট, রুয়েট এবং চুয়েটের কিছু শিক্ষার্থী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বিরুদ্ধে যে অভিযোগ এনেছেন, তা অমূলক সম্পূর্ণরূপে অযৌক্তিক। 

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের প্রতি বৈষম্য: মেধা ও অবদানকে অস্বীকার করার জাতীয় অপসংস্কৃতি


মাঠপর্যায়ের ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা: বাংলাদেশের অবকাঠামো উন্নয়নের নেপথ্য নায়ক

ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা বাংলাদেশের অবকাঠামো খাতে এক অপরিহার্য ভূমিকা পালন করেন। সড়ক, সেতু, ভবন থেকে শুরু করে শিল্পকারখানা—অধিকাংশ ক্ষেত্রেই তারা মাঠপর্যায়ে সরাসরি কাজের নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন। সরকারি তথ্য অনুযায়ী, দেশের ৮৫% এর বেশি ফিল্ডওয়ার্ক ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের তত্ত্বাবধানে সম্পন্ন হয়। তবুও তাদের এই গুরুত্বপূর্ণ অবদানকে প্রায়ই উপেক্ষা বা অস্বীকার করা হয়।


কর্মসংস্থানের বাস্তব চিত্র

বিএসসি ইঞ্জিনিয়ারদের কিছু দাবি থাকলেও, বাস্তবে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য সংরক্ষিত সরকারি পদ অত্যন্ত সীমিত। বর্তমানে কেবল ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলী পদেই তাদের সুযোগ রয়েছে, যা মোট সরকারি প্রকৌশল পদের মাত্র ১৫%। অথচ কিছু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এই অল্প সুযোগও বাতিল করতে চান।


অযৌক্তিক দাবির উদাহরণ

১. ৯ম গ্রেডে বিএসসি বাধ্যতামূলক করা এ প্রস্তাবের অর্থ হলো—একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার যত বছরের অভিজ্ঞতা, দক্ষতা ও মাঠপর্যায়ে নেতৃত্বদানের প্রমাণই রাখুন না কেন, কেবল একটি ডিগ্রির অভাবে তিনি যেন উচ্চপদে পদোন্নতির সুযোগ না পান। এটি শুধুমাত্র যোগ্যতার অপমান নয়, বরং মানবসম্পদের সঠিক ব্যবহার বাধাগ্রস্ত করার সরাসরি উদাহরণ। একটি উন্নয়নশীল দেশে মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা ও সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধান করার দক্ষতা—দুইই সমান গুরুত্বপূর্ণ।


২. ১০ম গ্রেডে উন্মুক্ত প্রতিযোগিতা সরকারি প্রকৌশল খাতে ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের জন্য যে কয়েকটি সংরক্ষিত পদ আছে, তার অন্যতম হচ্ছে ১০ম গ্রেডের উপ-সহকারী প্রকৌশলীর পদ। সেটি খোলা প্রতিযোগিতার আওতায় আনলে, বাস্তবে এটি একটি নির্দিষ্ট গোষ্ঠীর সুযোগকে পুরোপুরি সংকুচিত করে ফেলবে। যার ফলে মাঠপর্যায়ের কাজে অভিজ্ঞ, কিন্তু তুলনামূলক কম ডিগ্রি-ধারী পেশাজীবীরা কর্মক্ষেত্রে নিজেদের অবস্থান ধরে রাখা কঠিন হয়ে যাবে।


৩. ‘প্রকৌশলী’ উপাধি ব্যবহারে নিষেধাজ্ঞা এটি শুধু অবাস্তব নয়, পেশাগত মর্যাদার পরিপন্থীও বটে। একজন ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার, যিনি বছরের পর বছর দেশের সড়ক, সেতু, ভবন ও শিল্পপ্রকল্পে মূল ভূমিকা রাখছেন—তাকে যদি ‘প্রকৌশলী’ বলা না যায়, তবে প্রশ্ন জাগে, তার ভূমিকার স্বীকৃতি কোথায়? বাস্তব অভিজ্ঞতা ও মাঠে কাজের নেতৃত্ব দেওয়া সত্ত্বেও এই উপাধি থেকে বঞ্চিত করা মানে তাদের অবদানকে প্রাতিষ্ঠানিকভাবে অস্বীকার করা।


ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের সাত দফা যৌক্তিক দাবি


পদোন্নতির হার ৫০% করা – বর্তমান ৩৩% থেকে বাড়িয়ে মাঠপর্যায়ের অবদানের স্বীকৃতি দিতে হবে।


প্রশাসনিক পদে নিয়োগে বৈষম্য দূরীকরণ – প্রশাসন ক্যাডারের পরিবর্তে প্রকৌশল সংশ্লিষ্ট যোগ্য পেশাজীবীদের সুযোগ দিতে হবে।


কারিকুলাম উন্নয়ন – ইংরেজি মাধ্যমে সিলেবাস প্রণয়ন, ১:১২ শিক্ষক-শিক্ষার্থী অনুপাত, এবং ল্যাব ও ওয়ার্কশপ আধুনিকীকরণ।


বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে ইন্ডাস্ট্রিয়াল অ্যাটাচমেন্টের সুযোগ – সরকারি প্রতিষ্ঠানের মতো বেসরকারি শিক্ষার্থীদেরও সমান সুযোগ।


কর্মক্ষেত্র বিভাজন – বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের কাজ যথাক্রমে ডেস্ক ও ফিল্ডভিত্তিক ভাগ।


জনবল কাঠামো – ১:৫ অনুপাতে বিএসসি ও ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার নিয়োগ।


বৃত্তি বৃদ্ধি – শিক্ষার্থীদের আর্থিক সহায়তা বাড়ানো।


 বৈষম্যমূলক আচরণ: সভ্য সমাজে অগ্রহণযোগ্য

কিছু শিক্ষার্থী ও পেশাদার প্রকৌশলী ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ারদের বিরুদ্ধে অবমাননাকর মন্তব্য ও স্লোগান দিয়েছেন—যা কেবল পেশাগত অসম্মান নয়, বরং প্রকৌশল সমাজে বিভাজন ও সামাজিক সংহতির জন্য হুমকি।


ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা নিজেদের পরিচয়ে সর্বদা ‘ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়ার’ বলেন—এটি তাদের শিক্ষাগত পথ ও যোগ্যতার স্বচ্ছ ঘোষণা। ‘ডিপ্লোমা’ শব্দটি উপাধির অবিচ্ছেদ্য অংশ হওয়ায়, এটি ‘ইঞ্জিনিয়ার’ নামের অপব্যবহার নয়।


তবুও কিছু বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার এটিকে ভুলভাবে ‘প্রকৌশলী’ উপাধির লঙ্ঘন বা হুমকি হিসেবে দেখেন—যা বাস্তবে ভিত্তিহীন। আন্তর্জাতিকভাবে (যেমন জার্মানি, কানাডা, অস্ট্রেলিয়া) ডিপ্লোমা ও বিএসসি উভয় ধরনের ইঞ্জিনিয়ার নিজ নিজ পরিচয়ে সম্মানের সঙ্গে কাজ করেন। বাংলাদেশেও এই পারস্পরিক স্বীকৃতি ও পেশাগত মর্যাদা রক্ষা জরুরি।


অর্থনৈতিক ও আন্তর্জাতিক প্রেক্ষাপট

অর্থনৈতিক যুক্তি – মাঠপর্যায়ের অভিজ্ঞতা জাতীয় উন্নয়নের জন্য অত্যন্ত কার্যকর। ডিপ্লোমা ইঞ্জিনিয়াররা কম বয়সে কর্মক্ষেত্রে প্রবেশ করে হাতে-কলমে বাস্তব দক্ষতা অর্জন করেন।


আন্তর্জাতিক দৃষ্টান্ত – অস্ট্রেলিয়া, কানাডা, জার্মানি সহ অনেক দেশে ডিপ্লোমা ও বিএসসি ইঞ্জিনিয়ার সমান মর্যাদায় কাজ করেন। বাংলাদেশেও এ স্বীকৃতি দেওয়া উচিত।


ন্যায়বিচারের মূলনীতি – যারা মাঠে দীর্ঘদিন কাজ করে অভিজ্ঞতা অর্জন করেছেন, তারা পদোন্নতির যোগ্যতা রাখেন।


উপসংহার

দেশের উন্নয়ন ও অবকাঠামো খাতের সাফল্যে ডিপ্লোমা ও বিএসসি—উভয় ধরনের ইঞ্জিনিয়ারের সমন্বিত প্রয়াস দরকার। প্রতিযোগিতার বদলে সহযোগিতার মনোভাবই জাতীয় স্বার্থে কাজ করবে। সরকারকে উচিত সাত দফা যৌক্তিক দাবি বাস্তবায়ন করে দীর্ঘদিনের বৈষম্য দূর করা এবং একটি পেশাভিত্তিক ন্যায়সংগত পরিবেশ নিশ্চিত করা।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

0 মন্তব্যসমূহ